মিষ্টি মধুর প্রতিশোধ

 


লেখিকা : দিশা মনি

১.

নিজের হবু পাত্র হিসেবে এসএসসি পরীক্ষার ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখে অবাক হয়ে গেলো ইভানা। সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠে বলল,

'এই ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য আমি ম্যাট্রিক ফেল করেছি, ব্যাটা বজ্জাত আমার পাশ থেকে নড়ছিলই না। নাহলে ঠিকই পাশের জনের খাতা দেখে লিখে পাস করতাম। একে তো আমি ম'রে গেলেও বিয়ে করবো না।'


কথাটা বলেই এক ছুটে নিজের রুমে চলে আসে ইভানা। পুরো নাম তানজিলা ইসলাম ইভানা। তবে তার দাদা বাদে কেউই তানজিলা বলে ডাকে না। গতবছর এসএসসি দিয়েছে সে। কিন্তু পাস করতে পারেনি। যার ফলে এই এক বছর তাকে নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখতে হয়েছিলা। কারণ বাইরে গেলে যখন কেউ রেজাল্টের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত তখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতো না। আবার অনেকে তো টিটকারি করতো তাকে নিয়ে। যার কারণে তার জীবন পুরোপুরি নরক হয়ে গেছিল। এসবের জন্য সে এই ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়ী করে। তাই এখন যখন তার পাত্র হিসেবে এই ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে তখন তার মাথায় রাগ উঠে গেল। মনে পড়ে গেল এতদিনের সব অপমানের কথা। 


বড়লোক বাবার আদরের ছোট মেয়ে সে। তার বাবা তারিকুল ইসলাম শহরের একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। ইভানার পড়াশোনার পেছনে কম চেষ্টা করেন নি তিনি। কিন্তু ইভানা একদমই বই নিয়ে বসতে চায় না। যার কারণে আজ তার এই দশা। এমনকি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েও ইভানা কোনরকমে পাস করেছে। অথচ তার বড় বোন তোহা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তোহাও নিজের বাবার মতো বড় ডাক্তার হওয়ার আশা করে। 


দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়েও খারাপ রেজাল্ট করার কারণে ইভানার উপর খুব রেগে গেছে তার বাবা। যার ফলে ইভানার বিয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেই মেয়ে পড়াশোনা করে না, তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে কি লাভ? 


এই নিয়ে অবশ্য ইভানার কোন মাথাব্যথা নেই। পড়াশোনা তার এমনিতেও ভালো লাগে না। কিছুদিন আগেই তার ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে, তাই এখন আর বিয়ে করতে বাধা নেই। ইভানার আপত্তি শুধু একটা যায়গাতেই, তার জন্য তার বাবা যাকে পাত্র হিসেবে নির্বাচিত করেছে তাকে সে বিয়ে করতে পারবে না।


এই কারণে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় ইভানা। অতঃপর রুমে এসে ফোন লাগায় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আনহাকে। আরহা ইভানার বান্ধবী হলেও পড়াশোনায় অনেক ভালো, একজন মেধাবী ছাত্রী। এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন A+ পেয়েছিল। এখন সে ইন্টারে পড়ছে। এসএসসি পরীক্ষায় ইভানার পিছনেই আরহা বসেছিল। ইভানা মূলত আরহার ভরসাতেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ভেবেছিল আরহার দেখে লিখে পাস করবে। প্রথম কয়েকটা পরীক্ষা ঠিকই চলছিল কিন্তু গণিত পরীক্ষার দিন বাধে বিপত্তি। ম্যাজিস্ট্রেট ফারহান কবীর খবর পান যে পরীক্ষার হলে নাকি খুব দেখাদেখি চলে। এই খবর কানে আসা মাত্রই তিনি রেগে যান। কারণ পরীক্ষায় অনিয়ম তার পছন্দ না। সেই কারণে গণিত পরীক্ষার দিন তিনি সারাক্ষণ হলেই থাকেন। সবার মধ্যে ইভানা একটু এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল জন্য তিনি ইভানার দিকে লক্ষ্য রাখেন। যার কারণে ইভানা পিছনে ঘুরে আনহার দেখে লিখতেই পারে না৷ যার ফলস্বরূপ সে পরীক্ষায় ফেল করে। কারণ গণিতের কোন অংকই সে পারে না৷ 


ফোন সমান তালে বেজে চলেছে। কিছু সময় পর আনহা ফোন রিসিভ করতেই ইভানা বলে ওঠে, 

'জানিস দোস্ত কি হয়েছে?'


আনহা সবে বই খুলে পড়তে বসেছে। তার খুব ইচ্ছা বুয়েটে চান্স পাওয়ার। তাই অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এমন সময় ইভানার ফোন আসায় কিছুটা বিরক্ত হয় আনহা। তবে বান্ধবীকে তো আর উপেক্ষাও করতে পারে না। তাই আনহা যথাসম্ভব শান্ত থেকে বলে, 

'তুই না বললে জানব কিভাবে?'


আনহার এমন ত্যাড়া কথায় রাগ উঠে ইভানার। তবে এখন কথা বলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ জন্য বলে,

'আব্বু আমার বিয়ে দিতে চাইছেন।'


'এটা তো ভালো কথা। তুই তো পড়াশোনা করতে পারিসও না করতে চাসও না। বিয়ে করে নে, সেটাই ভালো।'


'বিয়ে নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস? আমাদের এসএসসি পরীক্ষার সময় যেই ম্যাজিস্ট্রেটের ডিউটি ছিল তার। ঐ শা'লার জন্য আমি পাস করতে পারিনি। আর আমি কিনা ওকে বিয়ে করব?'


ইভানার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে যায় আনহা। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে ইভানাকে পরামর্শ দেয়,

'তুই বরং বিয়েটা করেই নে।'


'কি বলছিস এটা তুই? যার জন্য ফেল করলাম তাকে বিয়ে করব!'


'আমার কথাটা আগে শোন, ঐ ম্যাজিস্ট্রেটের উপর তোর অনেক রাগ তাইতো?'


'রাগ থাকবে না? তুই তো দেখেছিস গণিত পরীক্ষার দিন কেমন শত্রুতা করেছিল আমার সাথে।'


'সেইজন্যই তো বলছি তুই বিয়েটা করে নে। বিয়ের পর শোধ তুলতে পারবি।'


ইভানা চকিত হয়ে বলে, 

'বাহ, তুই একদম ঠিক বলেছিস। এটা তো আমি ভেবেই দেখিনি। এইজন্য তুই A+ পাওয়া ছাত্রী আর আমি ফেলটুস ছাত্রী।'


'আচ্ছা। যা বললাম তাই কর। আমার অনেক পড়া বাকি আছে। পরে কথা হবে। বাই।'


'উম্মা দোস্ত বাই।'


ফোন রেখে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নেয় আনহা। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে,

'ইভানার বিয়েটা হলে তো ভালোই হবে। আরেকটা বিয়ে খেতে পারব।'


২.

ফারহান অনেকক্ষণ থেকে সোফায় বসে আছে। তবে এবার তার সত্যি অনেক বিরক্ত লাগছে। শুধুমাত্র নিজের মায়ের কথায় আজ পাত্রী দেখতে এসেছিল সে। ফারহানের তো এখন বিয়েশাদি করার কোন ইচ্ছাই নেই৷ কিন্তু আজকাল তার মা বিয়ের জন্য এত চাপ দিচ্ছে যে, মেয়ে দেখতে আসতেই হলো। কিন্তু কে জানতো, এমন একটা মেয়েকে দেখতে আসতে যে কিনা ম্যাট্রিক ফেল। এমনকি এখন তার ফেল করার জন্য সে ফারহানকে দোষ দিচ্ছে। ফারহানের ইচ্ছা ছিল এখনই এখান থেকে উঠে যাওয়ার কিন্তু তার মা ফারজানা বেগম তাকে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে। ফারহান সবার সামনে মায়ের অবাধ্য হতে চায়না জন্যই এতক্ষণ যাবৎ বসে আছে।


তারিকুল ইসলাম সোফায় বসে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। নিজের ছোট মেয়ের উপর রাগ তার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। একেই তো পরীক্ষায় ফেল করে তার মান সম্মান নষ্ট করে দিয়েছে তার উপর এখন যেসব কাণ্ড করছে তাতে তার মুখ আরো ছোট হচ্ছে। তারিকুল ইসলাম ক্ষুব্ধ গলায় নিজের স্ত্রী ইশরাত খাতুনকে বললেন,

'তোমার মেয়েকে ডেকে আনো এখুনি। কি পেয়েছে টা কি ও?'


'আমাকে ডাকতে হবে না। আমি এসে গেছি।'


গুটি গুটি পায়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল ইভানা। এসে একপলক তাকালো ফারহানের দিকে। ফারহান হয়তো প্রথম দেখায় তাকে চিনতে পারেনি কিন্তু ইভানা ঠিকই চিনে গেছে। আমরা যাকে ঘৃণা করি বা ভালোবাসি তাকে এত সহজে ভুলতে পারিনা। সেখানে ইভানা এই লোকটাকে তার ম্যাট্রিক ফেল করার একমাত্র কারণ মনে করে৷ তাই এক বছর পরেও মুখটা খুব ভালো করেই মনে রেখেছে। ফারহানের দিকে তাকিয়েই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় ইভানা,

'আমি প্রতিশোধ নেবোই। ফেল করার কারণে যত অপমান আর অবহেলা সহ্য করেছি তার শোধ আপনার থেকেই তুলব মিস্টার ম্যাজিস্ট্রেট।'


তারিকুল ইসলাম ইভানাকে শাসনের ভঙ্গিমায় বলেন,

'তুমি কোন সাহসে এখান থেকে উঠে গেলে? আর কিরকম ব্যবহার করলে ছি!'


ইভানা নিজেকে সামলে নেয়। প্রতিশোধ নিতে চাইলে এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তাই বেশ নম্রভাবে বলে,

'দুঃখিত, আসলে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম। গত একবছরের বিশ্রী স্মৃতিগুলোর জন্যই,,,'


'তুমি ফেইল করেছ সেটা তোমার দোষ, অন্যকারো না। আমি কি তোমার কোন কমতি রেখেছিলাম? প্রাইভেট, কোচিং-এ হাজার হাজার টাকা ঢেলেছি। কিন্তু তুমি তো ফাকিবাজি করে গেছ। যার ফলও হাতেনাতে পেয়েছ।'


ইভানাকে তাচ্ছিল্য করে উক্ত কথাগুলো বলেন তারিকুল ইসলাম। ইভানা মাথা নিচু করে থাকে। তারিকুল ইসলাম এবার ফারহানের মা ফারজানা বেগমের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমায় বলেন,

'আমার মেয়ের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখিত। ও যেমন ব্যবহার করল তারপর আমি আর কোন মুখে আপনাদের কিছু বলি। আমার এই মেয়ে আপনার ছেলের যোগ্য নয়। আপনারা শুধু শুধু এখানে এসে নিজের সময় নষ্ট করলেন।'


ফারজানা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

'আপনি ভুল ভাবতাছেন। আমাদের সময় মোটেই নষ্ট হয় নাই। আপনার মেয়েকেই আমি পোলার বউ করে ঘরে তুলমু।'


[আসসালামু আলাইকুম। নতুন গল্প নিয়ে উপস্থিত হলাম। জানি না কেমন হয়েছে। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।]



ফারজানা বেগমের কথা শুনে ওনার দিকে বিস্ময়কর ভাবে তাকায় সবাই। ফারহান বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেলে। তারিকুল ইসলাম বলেন, 

'এটা আপনি কি বলছেন? আপনার সত্যি আমার মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?'


ফারজানা বেগম মুচকি হাসলেন। অতঃপর ইভানাকে ইশারা করে নিজের কাছে ডাকলেন। ইভানা ফারজানা বেগমের পাশে বসতেই তিনি ইভানার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

'এই রকম পুতুলের মতো মাইয়াকে কার না পছন্দ হইবো। দেখতে তো মাশাল্লাহ, আমার ফারহানের পাশে খুব মানাবে।'


ইভানা খুশি হলো প্রচণ্ড। তারিকুল ইসলাম অবাক হলেন শুধু। তিনি তো ভেবেছিলেই পাত্রপক্ষের কেউ ইভানাকে পছন্দই করবে না। কারণ এমন উচ্চশিক্ষিত একজন ছেলে কোন দুঃখে একটা মেট্রিক ফেল মেয়ে বিয়ে করবে। তবে এখন তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তিনিও খুশি হলেন। ইশরাত খাতুন সবথেকে বেশি খুশি হলেন৷ আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া আদায় করলেন। নিজের মেয়ের জন্য এত ভালো সম্মন্ধ ঠিক হলে কোন মা খুশি না হয়ে থাকতে পারে।


ফারহান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন যেন তার ধৈর্য এবং সহ্যের ক্ষমতা পেরিয়ে যাচ্ছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এখন কিনা তাকে একজন ম্যাট্রিক ফেল করা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে! এটা তার সম্মানের জন্য হুমকি। লোকে তো হাসি তামাশা করবে তাকে নিয়ে। নিজের মাকে যথেষ্ট সম্মান করলেও নিজের বিয়ে নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলো না। কিন্তু সবার সামনে নিজের মায়ের উপর অভিরুচি তার নেই। সেই কারণে চুপচাপই রইল। বাড়িতে গিয়ে মাকে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তার আগে বিয়ে নিয়ে কথা উঠুক চাইছে না ফারহান। তাই সে সবার সামনে বলে উঠল,

'আমরা তাহলে এখন উঠি। বাড়ি গিয়ে আপনাদের বাকি কথা জানাচ্ছি।'


ফারহান কথাটা বলতে না বলতেই ফারজানা বেগম তার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন,

'বাড়িত গিয়া কেন সিদ্ধান্ত নিতে হইবো? যা সিদ্ধান্ত নেওনের আমি নিয়ে নিছি। এই মাইয়ার সাথেই তোর বিয়ে দিমু।'


ফারহান নিজেকে সামলানোর যথেষ্ট চেষ্টা করল। কিন্তু তার মেজাজ দ্রুত খারাপ হতে লাগল। সে উঠে পড়লো সোফা থেকে। অতঃপর দ্রুতবেগে হাটা ধরল। এখানে থাকলে মেজাজ আরো বেশি খারাপ হবে।


ফারহান চলে যেতেই তারিকুল ইসলাম বুঝতে পারলেন সে হয়তো এই বিয়েটা নিয়ে খুশি নয়৷ তাই তিনি ফারজানা বেগমকে বললেন,

'আপনারা একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। বিয়েটা তো আপনার ছেলের সাথেই হবে তাই তার মতেরও প্রয়োজন আছে। আমার মনে হয় আপনার ছেলে এই বিয়েতে রাজি হয়।'


'আমার পোলা আমার বাধ্য। তাই আমি যা কমু ও সেটাই করবো৷ আমি যখন কইছি এই মাইয়াই আমার ছেলের বউ হইবো তখন তাই হইবো।'


কথাটা বলে চায়ের কাপে শেষ চুমুক বসিয়ে দেন ফারজানা বেগম। অতঃপর নিজের ব্যাগ থেকে একজোড়া বালা বের করে ইভানার হাতে পরিয়ে দেন। মৃদু হেসে বলেন,

'এইডা আমার শাউরী(শাশুড়ী) আমায় দিয়া ছিল। এহন আমি তোমায় দিলাম। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হইছে৷ তোমার সাথে আমার মায়ের চেহারার অনেক মিল জানো। তুমি আমার ছেলের বউ হবা।'


ইভানা লাজুক হাসল। ফারজানা বেগম উঠে দাড়ালেন। তারিকুল ইসলামকে উদ্দ্যেশ করে বললেন,

'আমি তাইলে আইজ যাই। আমার পোলা বাইরে অপেক্ষা করছে। মাইয়া যেহেতু পছন্দ হইছে তাইলে আরেকদিন আইসা বিয়ার দিন তারিখ ঠিক করমু।'


সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে চলে এলেন ফারজানা বেগম। ফারহান গাড়িতে বসে ছিল। ফারজানা বেগম এসে গাড়িতে উঠতেই ফারহান কোন কথা না বলে গাড়ি চালানো শুরু করল। বাড়ি গিয়ে যা বলার বলবে বলে ভাবল সে।


৩.

আকাশে মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। আজকের আবহাওয়া বেশ সুন্দর। গাড়ি থেকে নেমে এই বাতাস বেশ উপভোগ করলেন ফারজানা বেগম। তিনি নিজের জীবনের অধিকাংশ সময় গ্রামেই অতিবাহিত করেছেন। শেষ বয়সে এসে ছেলেরা শহরে সেটেল্ড হওয়ায় তাদের সাথে শহরে চলে এসেছেন তিনি। শহরে সারাদিন এসির বাতাসে থাকতে থাকতে বেশ বিরক্ত তিনি। অনেকদিন পর বাইরের বাতাস তাই ভালোই উপভোগ করছেন। 


'আম্মু ভেতরে চলো। জরুরি কথা আছে।'


ফারহানের কথায় ধ্যান ভাঙল ফারজানা বেগমের। অতঃপর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। বাড়িতে এসে তিনি দেখলেন নামাজের সময় হয়ে গেছে। তাই তিনি আর সময় নষ্ট না করে নামাজ আদায় করে নিলেন। নামাজ আদায়ের পরে বসে বসে কোরআন তিলওয়াক্ত করছিলেন।


এমন সময় ফারহান তার কক্ষে প্রবেশ করলো। ফারজানা বেগমের কাছে এসে বলল,

'তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে আম্মু।'


'আমি জানি তুই কি কইতে চাস। শোন ঐ মাইয়াকে আমার অনেক পছন্দ হইছে। তুই যদি আমাকে মা হিসেবে সম্মান করস তাহলে আমার সিদ্ধান্ত মাইনা নে।'


'কিন্তু আম্মু ঐ মেয়ের সাথে আমার কিভাবে যায়?'


'যায় না কেন? ওর বয়স তো ১৮ হইয়া গেছে। আর তোর বয়সও যে খুব বেশি তা তো আর না। মাত্র ২৭ বছর।


'বয়সের জন্য না ঐ মেয়ে ম্যাট্রিক ফেল।'


'তাতে কি? আমি তো জীবনে ইস্কুলের গন্ডি দিয়ে যাই নাই। আমাকে যদি মা হিসাবে মানতে পারো তাইলে ঐ মাইয়ারে বউ হিসাবে মানতে কি অসুবিধা?'


'আম্মু কিছু বুঝতে পারছ না,,'


'আমার কিছু বোঝোনের নাই। তোমার বাপ তোমরা অনেক ছোট থাকতেই মারা গেছে। তহন থেইকা আমি একা হাতে তোমারে আর তোমার ছোট ভাইরে মানুষ করছি। এহন তুমি যদি আমার সেই কষ্টের মূল্য দিতে চাও তাইলে বিয়েটা কইরা নেও। আমার আর কিছু বলার নাই।'


ফারহান পড়ে গেল মহা সংকটে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে এখন সে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না৷ সব কেমন ফাকা ফাকা লাগছে।


৪.

ইভানা নিজের রুমে বসে দাত দিয়ে হাতের আঙুল কা'টছে। এটা তার একটা বদভ্যাস বলতে গেলে। যখনই কোন কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করে তখনই সে এমন করে। 


ইভানার এখন চিন্তার মূল কারণ হচ্ছে তার বিয়েটা নিয়ে। তখন আনহার কথা শুনে ঠিক করলো না ভুল সেটা নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। তার উপর এখন তার চিন্তা আরো বৃদ্ধি লাভ করেছে। কারণ ফারহানের মা ইতিমধ্যে তাকে পছন্দ করে তার হাতে নিজের বালা পর্যন্ত পড়িয়ে গেছে। এখন তার ভবিতব্য কি হতে চলেছে তা নিয়ে যথেষ্ট বিচলিত সে। এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা একপর্যায়ে তার মাথায় এলো ফারহানের কথা। ফারহানের ব্যবহারেই ইভানা বুঝে গেছে সে হয়তো এই বিয়েটা করতে চাচ্ছে না। ব্যাপারটা মনে হতেই শয়তানী টাইপ হাসি দিয়ে ইভানা বিড়বিড় করে বললো,

'বিয়ে তো আপনার আমাকেই করতে হবে। আপনার বউ হয়েই আমি মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করার শোধ তুলব।'


'কিসের শোধ নেওয়ার কথা বলছিস তুই?'


চিরপরিচিত গলার স্বর শুনে দরজার দিকে তাকায় ইভানা। তার বড় বোন তোহা দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। ইভানা তোহার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

'তেমন কিছু না আপাই। তুই কখন এলি?'


'এই একটু আগে। এসেই তোর এই শোধ নেওয়ার কথা শুনতে পেলাম। বাই দা ওয়ে, তোকে নাকি আজ দেখতে এসেছিল।'


'হুম। দেখ কি একটা অবস্থা। তুই আমার বড় বোন অথচ তোর আগেই আমার বিয়ে হচ্ছে। হি হি হি।'


'এটা মোটেই মজার ব্যাপার না ইভানা৷ তুই যদি একটু মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতি তাহলে এত তাড়াতাড়ি আব্বু তোর বিয়ের কথা ভাবত না। আমি তোকে কত করে পড়াশোনা করতে বলেছি কিন্তু তুই,,,'


ইভানা কানে হেডফোন গুঁজে বলে, 

'আমার দ্বারা এসব পড়াশোনা হবে না আপাই। আমি তোর মতো ওতো মেধাবী নই৷ তার থেকে ভালো বিয়ে করে নেই।'


'পড়াশোনা করার থেকে সংসার করা মোটেই সহজ কাজ না। বাড়িতে তো এক গ্লাস পানিও নিয়ে খাস না। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে যখন বাড়ির সব কাজ করতে হবে তখন বুঝবি৷ আফসোস করবি আর বলবি এর থেকে পড়াশোনাই ভালো ছিল।'


ইভানা হেডফোনের গানের তালে তালে তাল মিলাতে ব্যস্ত। তোহা আর কিছু না বলে বাথরুম চলে গেল ফ্রেশ হয়ে নিতে।


চলবে ইনশাআল্লাহ ✨


Post a Comment

Previous Post Next Post